দেশে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে ডেঙ্গি। থামছে না সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি। চলতি বছরে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসের ২১ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৮৬৬ জন।
এ বছর মোট রোগীর ৮৪ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে গেল দুই মাসে। তাদের বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৫৯ জন। গত ২০ বছরের ইতিহাসে এবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালে দেশে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্ত হয়েছিল। এদিকে ঢাকায় রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। অনেক হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে রোগী ফিরে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি হিসাবে প্রতিদিন ডেঙ্গি আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, বাস্তবে এটা আরও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু নির্দিষ্ট হাসপাতালের তথ্যই গণমাধ্যমে প্রকাশ করছে।
কিন্তু এর বাইরে অনেকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা সরকারি হিসাবে আসছে না। তাই সব মিলিয়ে ডেঙ্গি পরিস্থিতি ভয়াবহ। তাদের মতে, আরও কয়েক সপ্তাহ ডেঙ্গির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকতে পারে।
তাই এডিস মশার বিস্তার রোধে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নজর রাখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গিতে আতঙ্কিত না হয়ে লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি এবং বিভাগীয় হাসপাতালে ডেঙ্গি রোগী ভর্তি ও মৃত্যুর তালিকা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে দেখা যায়, ১৩টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছে।
বেশি মৃত্যুও হয়েছে এ হাসপাতালেই-১৩ জন। এরপরই রয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল। চলতি বছর এ হাসপাতালে মোট ৬৫৬ রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৯ জন, যা ঢাকার হাসপাতাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু।
বর্তমানে শিশু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪৬। মঙ্গলবার দুপুরে এ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ২নং ওয়ার্ডের কিছু অংশ সাদা কাপড় দিয়ে আলাদা করে ডেঙ্গি কর্নার করা হয়েছে। সেখানে শয্যা মাত্র ১৬টি।
সবকটি পূর্ণ। ডেঙ্গি ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে রোগী আসার প্রবণতা কমছে না। এখানে যে কয়টি শয্যা আছে তার দ্বিগুণ রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছেন। বাধ্য হয়ে ওদের অন্যান্য ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে। যারা আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল, তারা কেবিনে রোগী ভর্তি করাচ্ছেন।
ডেঙ্গি ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, রোগীদের বেশির ভাগের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। প্রত্যেকের হাতে বা পায়ে ক্যাথেটার লাগানো। তাদের সামলাতে অভিভাবকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। কথা হয় এ ওয়ার্ডে ভর্তি সাত মাসের শিশু এসএম মুনতাসির রহমানের বাবা মিজানুর রহমানের সঙ্গে।
তার বাসা কাজীপাড়া। যুগান্তরকে তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে বাচ্চার জ্বর ছিল। সোমবার পরীক্ষা করানোর পর ডেঙ্গি শনাক্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসি। ছেলের ডান পায়ে ক্যাথেটার লাগানো হয়েছে। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণায় বাচ্চা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না।
সারাক্ষণ তার হাত পা ধরে রাখতে হয়। সারা রাত ছেলের পাশে বাচ্চার মা ও আমি জেগে থাকি। তিনি বলেন, ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি সবারই সচেতনতা দরকার। শিশুদের জন্য এ রোগ কতটা ভয়াবহ, তা কারও বাচ্চা আক্রান্ত না হলে বুঝতে পারবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে দেশে ডেঙ্গি রোগী শনাক্ত হয়। ওই মাসে ২৭২ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
জুলাইয়ে ডেঙ্গি আক্রান্ত কয়েকগুণ বেড়ে হয় ২ হাজার ২৮৬ জন। আর আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৯৮। চলতি মাসের ২১ দিনে এ সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। ২৪ ঘণ্টায় দেশে হাসপাতালগুলোয় আরও ২৪৬ জন ভর্তি হয়েছেন।
এর মধ্যে ঢাকায় ২১১ ও রাজধানীর বাইরে ৩৫ জন। এ নিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬ হাজার ২২২। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৫ হাজার ১৩২ জন।
বর্তমানে সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩১ জন। এর মধ্যে রাজধানীতেই ৮৩৬ জন। চলতি বছর দেশে ডেঙ্গিতে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টে মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইয়ে ১২ আর চলতি মাসে ১৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গির তথ্য রাখছে। এতে দেখা যায়, ২০০০ সালে ৫ হাজার ৫৫১ জন রোগী ভর্তি হন। মারা যান ৯৩ জন। পরের বছর এ সংখ্যা কিছুটা কমলেও ২০০২ সালে শনাক্ত রোগী বেড়ে ছয় হাজার ছাড়ায়।
২০০১ ও ২০০২ সালে ডেঙ্গিতে মারা যান যথাক্রমে ৪৪ ও ৫৮ জন। এরপর টানা চার বছর ডেঙ্গিতে কোনো প্রাণহানি হয়নি। ২০১৮ সালে ফের ডেঙ্গি বড় আকার নেয়।
ওই বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৫০ হাজার ১৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন।
২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গি রোগী শনাক্ত হয়। ১৯ বছরের মোট রোগীর দ্বিগুণ শনাক্ত হয় ওই বছর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।
ওই বছর ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ লোক প্রাণ হারান। যদিও সরকারি হিসাবে সংখ্যাটি ছিল ১৭৯। ২০২০ সালে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১ হাজার ৪০৫। কিন্তু এ বছর ফের বাড়ে ডেঙ্গির প্রকোপ।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছর ডেঙ্গির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিমাত্রায় বৃষ্টি।
তাছাড়া লকডাউনের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেখানেও এডিস বংশবিস্তারের সুযোগ পায়। এডিসের লার্ভা ধ্বংসে বছরব্যাপী কোনো উদ্যোগ ছিল না। এডিশের প্রকোপ বাড়ার পর সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসে।
কিন্তু সেই উদ্যোগও যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতার অভাবও দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ডেঙ্গি পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
ড. বাশার বলেন, ডেঙ্গির এ প্রকোপ আরও কয়েক সপ্তাহ অব্যাহত থাকতে পারে। তাই এ নিয়ে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এখন আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে।
ডেঙ্গি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিন সব শিক্ষপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার করতে হবে। ডেঙ্গির লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে। শনাক্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
চলতি বছরে ডেঙ্গির সবচেয়ে ক্ষতিকর ধরনগুলোর একটি ‘ডেনভি-৩’ দ্বারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, ডেঙ্গির এই ধরনের কারণে দ্রুত রোগীদের রক্তের কণিকা প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে।
এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। এ ধরনের কারণেই চলতি বছরে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে বলেও গবেষণায় ওঠে আসে।
ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, মশার বংশবিস্তার রোধে আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। ২৬ জুলাই থেকে চিরুনি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। যেখানেই এডিসের লার্ভা থাকার খবর পাচ্ছেন, সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন তারা। ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগীর বাড়ির চারশ মিটার এলাকা তারা বিশেষভাবে ওষুধ ছিটাচ্ছেন। ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।